প্যারিস: বয়সের নানা অঙ্ক মাঝেমধ্যে গুলিয়ে যায় অলিম্পিকে।
জেং জিয়িং-এর জন্ম চিনের গুয়াংঝৌ শহরে। মুক্তোর নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরকে বাঙালিরা চেনে ক্যান্টন নামে। ১৯৬৬ সাল। চেয়ারম্যান মাও সে তুঙের নেতৃত্বে তখন পুরোদমে সাংস্কৃতিক বিপ্লবের আগ্রাসন চিনে। ঠাণ্ডা যুদ্ধের আবহে তোলপাড় ফেলা অবস্থা। মাওয়ের সঙ্গে মস্কোর নেতাদের মতবিরোধ চলছে। ছোট্ট জেং অবশ্য অতশত বুঝতেন না। মা ছিলেন টেবিল টেনিসের কোচ। জ্ঞান হওয়ার পর থেকে টেবিল টেনিসের ব্যাটকেই ভালবেসে ফেলেন জেং।
মাত্র নয় বছর বয়সে জেং-এর মা তাকে নিয়ে যান অ্যাকাডেমিতে। চিনে টেবিল-টেনিস (টিটি) প্রবল জনপ্রিয়। বস্তুত, পৃথিবীত চিন এই খেলায় অদ্বিতীয় নাম। প্রচুর ছেলেমেয়ে টিটি শিখতে আসে। অথচ তার মাঝেও নজর কাড়েন জেং। মাত্র ১২ বছর বয়সে পেশাদার টিটিতে প্রবেশ করেন জেং। জাতীয় স্তরে জুনিয়র চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন। মাত্র ১৬ বছর বয়সেই চিনের জাতীয় দলের তরফে ডাক আসে জেং-এর।
টিটি তখনও অলিম্পিকে খেলা হত না। ১৯৮৮ সালের সোল অলিম্পিকে প্রথম টিটির প্রবেশ ঘটে। অথচ তার আগেই, ১৯৮৬ সালে ঘটে যায় ছন্দপতন। ব্যাটের রঙ নিয়ে সমস্যায় পড়েন জেং। নিয়ম করা হয়েছিল, ব্যাটের দুই দিকের দু’রকম রঙ থাকবে। কিন্তু তাতেই জেং-এর টেকনিকে সমস্যা শুরু হয়। কিছুতেই মানাতে পারেননি। শেষ অবধি জাতীয় দল ছাড়তে হয় তাঁকে।
চিনে তখন ফের নতুন করে মাথাচাড়া দিচ্ছে উত্তেজনা। সোভিয়েত ইউনিয়ন টালমাটাল। তিয়েনআনমেন স্কোয়ারে সাঁজোয়া গাড়ির লৌহমুষ্টিতে চূর্ণ অভ্যুত্থান। জেংকে সরে আসতে হল টেবিল টেনিস থেকে। কিন্তু এইরকম সময় একটা অদ্ভুত আমন্ত্রণ আসে তাঁর কাছে। পৃথিবীর অন্য এক গোলার্ধে, আন্দিজ পাহাড়ের কোলে দক্ষিণ আমেরিকার চিলে থেকে।মাতৃভূমির হয়ে অলিম্পিক খেলার স্বপ্ন ছিল জেং-এর। শেষ অবধি সেটা আর হয়নি। এখন তাঁর বয়স ৫৮। কিন্তু চিলের হয়ে অলিম্পিক খেলার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে তাঁর। ৫৮ বছর বয়সে প্যারিস অলিম্পিকের অন্যতম প্রবীণতম খেলোয়াড় জেং। চিলের গেমস ভিলেজে এখন সেরা আকর্ষণ তিনি।
চিলের আমজনতা তাঁকে ভালবেসে বলেন ‘টেবিল টেনিস গ্র্যান্ডমা’। অবশ্য এখনও সরকারিভাবে ‘ঠাকুমা’ হ’ননি তিনি। যেখানেই খেলতে যান, জনতার উৎসুক ভিড় ঘিরে ধরে তাঁকে। সকলের বক্তব্য, অসাধারণ একজন মানুষ জেং। সাংস্কৃতিক দূরত্ব কোনও বাধাই হয়নি তাঁর জন্য। এমনিতেই লাতিন আমেরিকার সংস্কৃতি উদারতার জন্য বিখ্যাত। জেং-ও দিব্যি স্পেনীয় শিখে নিয়েছেন। নিজেকে পুরোদস্তুর চিলেয়ান বা চিলের নাগরিক বলেই পরিচয় দেন। ৩৫ বছরের ওপর সেদেশে আছেন তিনি। ঝরঝরে স্পেনীয় বলেন। চিলের স্থানীয় খাবারাদাবারেই আগ্রহ তাঁর। ‘জেং জিয়িং’ নামটা উচ্চারণ করতে সমস্যা হত চিলের অধিবাসীদের। ভালবেসে তারা তাঁর নাম দিয়েছে ‘তানিয়া’। বা আরও ভাল করে বললে, ‘তিয়া তানিয়া’। অর্থাৎ, ‘আন্টি তানিয়া’।
জেং দিব্যি উপভোগ করেন সেসব। বলেন, ‘আমার তো শুনতে ভালই লাগে।’ অবশ্য প্যারিস অলিম্পিকে ৫৮ বছরে ডেবিউ করলেও, প্রথম রাউন্ডের বেশি এগোতে পারেননি জেং। লেবাননের মারিয়ানা শাহাকিয়ানের কাছে হেরে গিয়েছেন তিনি।
তবে তাতে অবশ্য প্রিয় তানিয়ার জন্য ভালবাসায় কমতি নেই চিলির মানুষের।